ভূমিকা :
বাংলা লিপি হল একটি লিখন পদ্ধতি যেটা ব্যবহার করা হয় বাংলা, মণিপুরি, ককবরক, অসমীয়া ভাষায়। এ লিপি এসেছে পূর্ব নাগরী লিপি থেকে। বাংলা লিপির গঠন তুলনামূলকভাবে কম আয়তাকার ও বেশি সর্পিল। বাংলা লিপিটি সিদ্ধং লিপি থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে মনে করা হয়। অনুরূপ হিসাবে অসমিয়াকে মনে করা হলেও অসমীয়া লিপির উৎপত্তি বাংলা লিপি উৎপত্তির অন্তত আড়াইশ বছর পর। যে ভিন্নতা (বাংলা র; অসমীয়া ৰ ) আধুনিক বাংলা ও অসমীয়া ভাষায় দেখা যায়, সেটি ১৮ শতকের আগে ছিল না। পরবর্তিতে নিচে ফোঁটা দেওয়া র বাংলায় ব্যবহৃত হয়। পূর্ব নাগরী লিপি বা বাংলা লিপি বিশ্বের ৬ষ্ঠ সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত লিখন পদ্ধতি।
উৎস :
খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয়-প্রথম শতকে ব্রাহ্মী লিপির উত্তর ভারতীয় লিপিরূপ থেকে জন্ম নেয় কুষাণ লিপি, যা থেকে পরে গুপ্ত লিপির উৎপত্তি হয়। গুপ্ত লিপির ক্রমবিবর্তনের ফলে সিদ্ধমাতৃকা লিপির উৎপত্তি হয়, যার কালক্রমিক পরিণতি থেকে বাংলা লিপি বর্তমান রূপ ধারণ করে। বাংলা লিপির ব্যবহার প্রায়ই মধ্যযুগীয় ভারতের পূর্বাঞ্চলে এবং তারপর পাল সাম্রাজ্যের মধ্যে ব্যবহার ছিল। পরে বিশেষভাবে বাংলার অঞ্চলে ব্যবহার করা অব্যাহত ছিল। পরে বাংলা লিপিটিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বের অধীনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দ্বারা আধুনিক বাংলা লিপিতে প্রমিত করা হয়েছিল। বর্তমান দিনে বাংলা লিপিটি বাংলাদেশ ও ভারতে সরকারী লিপির পদমর্যাদা স্থানে আছে, এবং বাংলার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যুক্ত আছে।
বাংলা মুদ্রণের প্রথম অর্ধশতাব্দী :
১৭৭৮ সালে ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেডের (হালেদ) আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রকাশনার মাধ্যমে বাংলা মুদ্রণশিল্পের জন্ম হয়। বইটি ইংরেজি ভাষাতে লেখা হলেও এতে বাংলা বর্ণপরিচয় ও বাংলা লেখার নিদর্শন সবই বাংলা মুদ্রাক্ষরে ছাপা হয়। এই মুদ্রণে প্রথমবারের মত "বিচল হরফ" প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এই কৌশলে প্রতিটি হরফের জন্য আলাদা একটি ব্লক থাকে, যে ব্লকটিকে ইচ্ছামত নড়ানো ও বসানো যায়। জার্মানির ইয়োহানেস গুটেনবের্গ ছিলেন এই প্রযুক্তির উদ্ভাবক। বাংলা মুদ্রণে হালেদের বইতে চার্লস উইলকিন্স এবং তার সহকারী পঞ্চানন কর্মকার এই প্রযুক্তি প্রথমবারের মত প্রয়োগ করেন। ধাতুর ব্লকে ঢালাই করা একই আকৃতি একই হরফের জন্য একাধিক পাতাতে ব্যবহার করা যায় বলে বাংলা ছাপা হরফে একটা স্থায়ী, বৈষম্যহীন রূপ এসেছিল। তবে এই প্রথম দিককার হরফগুলি খুব সুদৃশ্য ও পরিণত ছিল না। ইংরেজির তুলনায় বাংলা হরফের আকার ছিল বেশ বড়। ইউরোপে এর প্রায় তিনশত বছর আগেই বিচল হরফে ছাপার প্রযুক্তি শুরু হয়ে গেলেও বাংলাতে এটি ছিল একেবারেই নতুন একটি ঘটনা। চার্লস উইলকিন্স ও তার সহকারী পঞ্চানন কর্মকার সম্ভবত এই বিষয়ে অভিজ্ঞ কারিগর ছিলেন না। ১৮০০ সালে শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে উইলিয়াম কেরি ও উইলিয়াম ওয়ার্ড ছিলেন ছাপখান বিশেষজ্ঞ। তারা সেখানে পঞ্চানন কর্মকারের চাকরির ব্যবস্থা করেন। এদের মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলা হরফের চেহারার উন্নতি হতে থাকে। ১৯শ শতকের তৃতীয় দশকেই বাংলা ছাপার চেহারা অনেকখানি পাল্টে যায়। ১৮৩১ সালে ভিনসেন্ট ফিগিন্স সম্ভবত প্রথম বাণিজ্যিকভাবে বিক্রির জন্য বাংলা হরফ তৈরি করেছিলেন। এসময়কার বাংলা হরফের বৈশিষ্ট্যগুলি এরকম:
• অনুস্বারের নিচের দাগটি ছিল না। ছিল কেবল গোল চিহ্নটি।
• ব্যঞ্জনের খাড়া দাগের সাথে য-ফলা মিলে বাঁকিয়ে কমলার কোয়ার মত একটা চেহারা ছিল। এগুলি আজও কখনো কখনো দেখতে পাওয়া যায়। আধুনিক কম্পিউটারের লিখন হরফে স্য-তে এর দেখা মেলে।
• "তু" যুক্তাক্ষরটি বর্তমান চেহারা পায়। অর্থাৎ "ত"-এর নিচে "ু" বসিয়ে।
• "স্থ" (স+থ) যুক্তাক্ষরটি হালেদের সময়ে, অর্থাৎ ১৮শ শতকে "স"-এর নিচে পরিষ্কার "থ" লিখে দেখানো হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে এটি "স"-এর নিচে ছোট "হ"-এর মত অক্ষর বসিয়ে নির্দেশ করা হয়। ফলে যুক্তাক্ষরটি অস্বচ্ছ রূপ ধারণ করে। এখনো এই অস্বচ্ছ রূপটিই ব্যবহার করা হয়। এরকম আরো বহু যুক্তাক্ষরের অস্বচ্ছ রূপ ১৯শ শতকের শুরুর এই পর্বে নির্দিষ্ট হয়ে যায়।
• "র" অক্ষরটির হরফটি হালেদের সময়ে পেট কাটা "ব" (অসমীয়া ৰ) এবং "ব"-এর নিচে ফুটকি উভয় রূপেই বিদ্যমান ছিল। কিন্তু ১৮শ শতকের মাঝামাঝিতে এই পর্বের শেষে এসে বর্তমান ফুটকিযুক্ত রূপটিই সর্বত্র চালু হয়ে যায়।
বিদ্যাসাগরীয় সংস্কার :
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে জীবিকা অর্জনের জন্য একটি ছাপাখানা খোলেন। বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালা সংস্কারের জন্য অনেকগুলি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এগুলি হল এরকম:
• সংস্কৃতের "य" বর্ণটি বাংলায় "য" হরফ দিয়ে লেখা হত, কিন্তু শব্দে অবস্থানভেদে এর উচ্চারণ "জ" কিংবা "য়"-এর মতো উচ্চারিত হত। বিদ্যাসাগর "জ" উচ্চারণের ক্ষেত্রে "য" বর্ণটি ব্যবহার এবং "য়" উচ্চারণের ক্ষেত্রে "য"-এর নিচে ফুটকি দিয়ে নতুন বর্ণটি ব্যবহারের প্রস্তাব করেছিলেন।
• একইভাবে "ড" ও "ঢ"-এর নিচে ফুটকি দিয়ে বিদ্যাসাগর "ড়" ও "ঢ়" হরফ দুইটির প্রচলন করেছিলেন।
• বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষায় অব্যবহৃত "দীর্ঘ-ৠ" ও "দীর্ঘ-ৡ" বর্ণ দুইটি বর্জন করেছিলেন। তবে কেবল "ঌ" বর্ণটিও বাংলায় অব্যবহৃত ছিল, কিন্তু বিদ্যসাগর এ নিয়ে কিছু বলেননি।
• এছাড়া সংস্কৃত স্বরবর্ণমালার অন্তর্গত অনুঃস্বর (ং), বিসর্গ (ঃ), এবং চন্দ্রবিন্দু (ঁ) যেহেতু প্রকৃতপক্ষে ব্যঞ্জনবর্ণ সেহেতু বিদ্যাসাগর এই বর্ণগুলিকে ব্যঞ্জনবর্ণমালার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু ব্যঞ্জনবর্ণ হলেও যেহেতু এগুলি স্বতন্ত্র বর্ণ নয়, অযোগবাহ বর্ণ সেহেতু কোন বাংলা অভিধানেই বিদ্যাসাগরপ্রণীত বর্ণক্রমটি গৃহীত হয়নি।
বিদ্যাসাগর "ণ-ন" এবং "শ-ষ-স"-এর মধ্যে উচ্চারণের সমতা সম্ভবত লক্ষ্য করলেও এর কোন সংস্কার করেন নি। বিদ্যাসাগর বাংলা হরফের স্বচ্ছতা ও সমতা বিধানের জন্যও বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন:
• তিনি যফলাকে ব্যাঞ্জনের সাথে যুক্ত করে কমলার কোয়ার মতো না লিখে আলাদা করে লেখার ধারা চালু করেন। ফলে সর্বত্র যফলার আকার একই রূপ পেল।
• বিদ্যাসাগরের আগে ঋ-কার ব্যঞ্জনের তলে বিভিন্ন রূপে বসত। বিদ্যসাগরই প্রথম ব্যঞ্জনের নিচে পরিষ্কারভাবে "ৃ" চিহ্নটি বসিয়ে লেখা চালু করেন।
• একইভাবে হ্রস্ব-উ কারের জন্য "ু" লেখা চালু করেন।
কিন্তু বিদ্যাসাগরের সংস্কারগুলি সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। অনেকগুলি অস্বচ্ছ যুক্তব্যঞ্জনের চিহ্ন অস্বচ্ছই থেকে গিয়েছিল। যেমন - "তু" "ত"-এর নিচে উ-কার দিয়ে লেখা হলেও "ন্তু", "স্তু" যুক্তাক্ষরগুলিতে পুরনো অস্বচ্ছ রূপটিই থেকে গেল।
ইংরেজি বিচল হরফগুলি একটি ডালায় দুই খোপে নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী সাজানো থাকত। কিন্তু বাংলায় এ নিয়ে তেমন কোন চিন্তা হয় নি। বিদ্যাসাগরই প্রথম বাংলা হরফের জন্য ডালার একটি নকশা এবং কোন হরফের পর কোন হরফ বসবে তার নিয়ম স্থির করে দেন। তার এই নকশাই ক্রমে সমস্ত বিচল হরফ ব্যবহারকারী বাংলা ছাপাখানাতে গৃহীত হয়। বাংলা মুদ্রণশিল্পে প্রতিষ্ঠিত হয় সমতা। বিদ্যাসাগর বাংলা মুদ্রণশিল্পকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। মূলত তার বেঁধে দেয়া নিয়মনীতি অনুসারেই পরবর্তী একশো বছর, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাংলা হরফ মুদ্রিত হয়।
সময়ের সাথে বিদ্যাসাগরীয় হরফের সামান্য কিছু পরিমার্জনের চেষ্টাও করা হয়েছে। বিদ্যাসাগর নিজে বর্ণপরিচয়-এর ৬০তম সংস্করণ থেকে শব্দের শেষে অন্তর্নিহিত ও উচ্চারণযুক্ত ব্যঞ্জন, যেমন- "বিগত", "কত" শব্দের শেষের "ত"-টা, যেন "ৎ"-এর মত উচ্চারণ না হয়, সেজন্য এগুলির উপর তারাচিহ্ন দেয়া প্রবর্তন করেন। বিংশ শতাব্দীতে অনেক লেখক একই কাজে ঊর্ধ্বকমা (') ব্যবহার করেছেন, যেমন- একশ', ইত্যাদি। তবে এই সংস্কারটি সর্বজনগৃহীত হয়নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাসাগরী হরফের দুই ধরনের এ-কার (মাত্রাছাড়া ও মাত্রাসহ) দুইটি ভিন্ন কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। তিনি শব্দের শুরুর মাত্রাযুক্র এ-কার দিয়ে "অ্যা" ধ্বনি বুঝিয়ে ছাপানো শুরু করেন। তবে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য বেশির ভাগ প্রকাশকই এই রীতিটি গ্রহণ করেনি।
লাইনোটাইপ পর্ব :
ইউরোপে ১৯শ শতকের শেষ দিকে লাইনোটাইপ মেশিনে ছাপানোর চল হয়। ১৯৩০-এর দশকে বাংলা হরফও লাইনো মেশিনে ছাপানোর চিন্তাভাবনা শুরু হয়। লাইনোটাইপ মেশিনে ছাপানোর অনেক সুবিধা থাকলেও এর একটি অসুবিধা ছিল এতে আড়াইশো-র মত চিহ্ন রাখার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বিদ্যাসাগরীয় পদ্ধতিতে হরফের সংখ্যা ছিল বিশাল। "করণ টাইপ" নামের এক পদ্ধতিতে এর সংখ্যা কমলেও তার পরেও সব মিলিয়ে প্রায় ৬০০-র মত হরফের ব্লক প্রয়োজন হত। আনন্দবাজার প্রকাশনা সংস্থার সুরেশচন্দ্র মজুমদার রাজশেখর বসুর পরামর্শে বাংলা হরফের বিরাট আকারের সংস্কার সাধন করেন। তিনি স্বরবর্ণের কার-চিহ্নগুলি সকল ক্ষেত্রে একই আকারের রাখার ব্যবস্থা করলেন এবং এগুলি ব্যঞ্জন বা যুক্তব্যঞ্জনের নিচে বা উপরে না বসিয়ে সামান্য ডানে বা বামে সরিয়ে আলাদা অক্ষর হিসেবে ছাপার ব্যবস্থা করলেন।
এছাড়াও তিনি অনেক যুক্তব্যঞ্জনের একই উপাদান ব্যঞ্জনাক্ষরের সাধারণ আদল আলাদা করে সেটির হরফ বানালেন, ফলে যুক্তব্যঞ্জন ছাপানোতেও হরফের সংখ্যার অনেক সাশ্রয় হল। শেষ পর্যন্ত সুরেশচন্দ্র বাংলা হরফের সংখ্যাকে চাবির ডালায় ১২৪টি এবং বিবিধ আরও ৫০টিতে নামিয়ে আনতে পেরেছিলেন।
তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া